আজ ১০:৪৮ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
[gtranslate]

ইসরায়েলি বন্দিদের নিয়ে জুয়া খেলছেন নেতানিয়াহু

  • রিপোর্টার
  • আপডেট টাইম : ০৪:১৮:০৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৫ মার্চ ২০২৫
  • ১০৬ বার

বর্তমানে প্রায় সব ইসরায়েলিই অনুধাবন করতে পারছেন হামাসের ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’-এর পর থেকে গোষ্ঠীটির হেফাজতে থাকা বন্দিদের প্রায় সকলের অনেক আগেই মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এবং তারা এটাও বুঝতে পেরেছেন বারবার তাদের মুক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নিজের স্বার্থকে দেশের স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখা দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

আদতে কখনোই এই যুদ্ধ শেষ করতে চাননি তিনি। বরং নেতানিয়াহু মনে করতেন যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হবে, বন্দিদের ফিরে আসার সম্ভাবনা তত কমবে।

হামাসের হামলার ফলে ইসরায়েল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, একের পর এক জনমত জরিপ দেখিয়েছে যে ইসরায়েলিরা যুদ্ধবিরতি ও বন্দিবিনিময় চুক্তি চায়। এই পরিস্থিতিতে মিশর, কাতার এবং যুক্তরাষ্ট্র কয়েকবার সমঝোতার জন্য চেষ্টা চালালেও প্রতিবারই শেষ মুহূর্তে পিছপা হয়েছেন নেতানিয়াহু। এর ফলে একদিকে যেমন হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, তেমনি ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন বহু বন্দি।

নভেম্বরে দ্বিতীয়বারের মতো ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় এই দৃশ্যপটের বাঁক বদলে দেয়। বাইডেন প্রশাসন গাজায় হত্যাযজ্ঞ থামাতে ব্যর্থ হলেও, ট্রাম্প কঠোরভাবে সবাইকে চুক্তিতে আসতে বাধ্য করেন। ট্রাম্পকে ক্ষুব্ধ না করে নেতানিয়াহু শেষ পর্যন্ত তিন ধাপের একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মত হন। চুক্তিটিতে সব বন্দিকে মুক্তি দেওয়া এবং ইসরায়েলি বাহিনীকে গাজা থেকে প্রত্যাহারের কথা বলা হয়।

কিন্তু নেতানিয়াহুকে কখনোই বিশ্বাস করা যায় না। প্রথম ধাপে ৩০ জনের বেশি ইসরায়েলি ও কয়েকশ ফিলিস্তিনি মুক্তি পেলেও, দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশের আগেই চুক্তি লঙ্ঘনের পথ বেছে নিয়েছেন নেতানিয়াহু।

রবিবার তিনি গাজায় সব ধরনের মানবিক সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দিয়ে বলেন, হামাস আরও বন্দি মুক্তি দিলেও ইসরায়েল গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে না। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে ইসরায়েলকে চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করেছে মিশর ও কাতার।

সোমবার নেতানিয়াহু আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে পানি ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধের হুমকি দিয়ে ইঙ্গিত দেন যে ইসরায়েল আবার গাজায় হামলা চালাতে পারে। তার মন্ত্রীরা হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে আরও দক্ষিণে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে বলেও জানান তিনি।

জাতিসংঘ ও অন্যান্য ত্রাণ সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে, খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হলে গাজায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, রাশিয়া, জাপানসহ অনেক দেশ ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে আহ্বান জানাচ্ছে।

ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। বন্দিদের পরিবারগুলো রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে, প্রতিবাদ জানাচ্ছে নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। বিরোধী দল বলছে, নেতানিয়াহু শুধুমাত্র তার জোট সরকার টিকিয়ে রাখতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী। আর এজন্য ইসরায়েলি বন্দিদের নিয়ে অব্যাহতভাবে জুয়া খেলে চলেছেন তিনি।

দেশটির উগ্র-জাতীয়তাবাদী মন্ত্রী ইতামার বেন গাভির আগেই পদত্যাগ করেছেন। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোতরিচও দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শুরু হলে সরকার ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।

নেতানিয়াহু যুদ্ধ ও অস্থিরতাকে তার রাজনীতিতে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছেন। তিনি পশ্চিম তীরের শরণার্থী শিবিরগুলো ধ্বংস করে অর্ধ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করে উগ্র-ডানপন্থী মিত্রদের সন্তুষ্ট রেখেছেন। এখন তিনি যুদ্ধবিরতি ভেঙে গাজার পুনর্গঠনের পরিকল্পনা বানচাল করতে চাইছেন। অন্যথায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অজুহাত হারিয়ে ফেলবেন তিনি।

ইসরায়েলি জনসাধারণের সমর্থনও হারিয়েছেন নেতানিয়াহু। ইসরায়েলিরা বন্দিদের মুক্তি চায় এবং যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে চায়। তাদের বিশ্বাস, যুদ্ধ আবার শুরু হলে বাকি জীবিত বন্দিরাও মারা যাবে। তারা এটাও জানে যে হামাস তাদের অংশের চুক্তি মেনে চলেছে, কিন্তু নেতানিয়াহু তা করেননি।

জনগণের পক্ষ নেওয়া সামরিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিচ্ছেন নেতানিয়াহু। তাই নেতানিয়াহুর স্বার্থ এবং ইসরায়েলি জনআকাঙ্ক্ষা যে এক নয়— ট্রাম্প প্রশাসনকে এটা বুঝতে হবে। কারণ যুদ্ধ আবার শুরু হলে, ফিলিস্তিনি ও বন্দিদের পাশাপাশি গোটা ইসরায়েলের জন্য এটি আরও বিপর্যয়কর হয়ে উঠবে।

ট্যাগ :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয়

ইসরায়েলি বন্দিদের নিয়ে জুয়া খেলছেন নেতানিয়াহু

আপডেট টাইম : ০৪:১৮:০৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ৫ মার্চ ২০২৫

বর্তমানে প্রায় সব ইসরায়েলিই অনুধাবন করতে পারছেন হামাসের ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’-এর পর থেকে গোষ্ঠীটির হেফাজতে থাকা বন্দিদের প্রায় সকলের অনেক আগেই মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল। এবং তারা এটাও বুঝতে পেরেছেন বারবার তাদের মুক্তির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন নিজের স্বার্থকে দেশের স্বার্থের ঊর্ধ্বে রাখা দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

আদতে কখনোই এই যুদ্ধ শেষ করতে চাননি তিনি। বরং নেতানিয়াহু মনে করতেন যুদ্ধ যত দীর্ঘায়িত হবে, বন্দিদের ফিরে আসার সম্ভাবনা তত কমবে।

হামাসের হামলার ফলে ইসরায়েল ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও, একের পর এক জনমত জরিপ দেখিয়েছে যে ইসরায়েলিরা যুদ্ধবিরতি ও বন্দিবিনিময় চুক্তি চায়। এই পরিস্থিতিতে মিশর, কাতার এবং যুক্তরাষ্ট্র কয়েকবার সমঝোতার জন্য চেষ্টা চালালেও প্রতিবারই শেষ মুহূর্তে পিছপা হয়েছেন নেতানিয়াহু। এর ফলে একদিকে যেমন হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন, তেমনি ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন বহু বন্দি।

নভেম্বরে দ্বিতীয়বারের মতো ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় এই দৃশ্যপটের বাঁক বদলে দেয়। বাইডেন প্রশাসন গাজায় হত্যাযজ্ঞ থামাতে ব্যর্থ হলেও, ট্রাম্প কঠোরভাবে সবাইকে চুক্তিতে আসতে বাধ্য করেন। ট্রাম্পকে ক্ষুব্ধ না করে নেতানিয়াহু শেষ পর্যন্ত তিন ধাপের একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরে সম্মত হন। চুক্তিটিতে সব বন্দিকে মুক্তি দেওয়া এবং ইসরায়েলি বাহিনীকে গাজা থেকে প্রত্যাহারের কথা বলা হয়।

কিন্তু নেতানিয়াহুকে কখনোই বিশ্বাস করা যায় না। প্রথম ধাপে ৩০ জনের বেশি ইসরায়েলি ও কয়েকশ ফিলিস্তিনি মুক্তি পেলেও, দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশের আগেই চুক্তি লঙ্ঘনের পথ বেছে নিয়েছেন নেতানিয়াহু।

রবিবার তিনি গাজায় সব ধরনের মানবিক সহায়তা বন্ধের ঘোষণা দিয়ে বলেন, হামাস আরও বন্দি মুক্তি দিলেও ইসরায়েল গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে না। এ ঘটনায় ইতিমধ্যে ইসরায়েলকে চুক্তি লঙ্ঘনের জন্য অভিযুক্ত করেছে মিশর ও কাতার।

সোমবার নেতানিয়াহু আরও এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে পানি ও জ্বালানি সরবরাহ বন্ধের হুমকি দিয়ে ইঙ্গিত দেন যে ইসরায়েল আবার গাজায় হামলা চালাতে পারে। তার মন্ত্রীরা হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে আরও দক্ষিণে সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা করছে বলেও জানান তিনি।

জাতিসংঘ ও অন্যান্য ত্রাণ সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে, খাদ্য সরবরাহ বন্ধ হলে গাজায় দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, রাশিয়া, জাপানসহ অনেক দেশ ইসরায়েলকে যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে আহ্বান জানাচ্ছে।

ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। বন্দিদের পরিবারগুলো রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করছে, প্রতিবাদ জানাচ্ছে নেতানিয়াহুর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। বিরোধী দল বলছে, নেতানিয়াহু শুধুমাত্র তার জোট সরকার টিকিয়ে রাখতে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষপাতী। আর এজন্য ইসরায়েলি বন্দিদের নিয়ে অব্যাহতভাবে জুয়া খেলে চলেছেন তিনি।

দেশটির উগ্র-জাতীয়তাবাদী মন্ত্রী ইতামার বেন গাভির আগেই পদত্যাগ করেছেন। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোতরিচও দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা শুরু হলে সরকার ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন।

নেতানিয়াহু যুদ্ধ ও অস্থিরতাকে তার রাজনীতিতে টিকে থাকার কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছেন। তিনি পশ্চিম তীরের শরণার্থী শিবিরগুলো ধ্বংস করে অর্ধ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনিকে বাস্তুচ্যুত করে উগ্র-ডানপন্থী মিত্রদের সন্তুষ্ট রেখেছেন। এখন তিনি যুদ্ধবিরতি ভেঙে গাজার পুনর্গঠনের পরিকল্পনা বানচাল করতে চাইছেন। অন্যথায় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অজুহাত হারিয়ে ফেলবেন তিনি।

ইসরায়েলি জনসাধারণের সমর্থনও হারিয়েছেন নেতানিয়াহু। ইসরায়েলিরা বন্দিদের মুক্তি চায় এবং যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে চায়। তাদের বিশ্বাস, যুদ্ধ আবার শুরু হলে বাকি জীবিত বন্দিরাও মারা যাবে। তারা এটাও জানে যে হামাস তাদের অংশের চুক্তি মেনে চলেছে, কিন্তু নেতানিয়াহু তা করেননি।

জনগণের পক্ষ নেওয়া সামরিক ও নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিচ্ছেন নেতানিয়াহু। তাই নেতানিয়াহুর স্বার্থ এবং ইসরায়েলি জনআকাঙ্ক্ষা যে এক নয়— ট্রাম্প প্রশাসনকে এটা বুঝতে হবে। কারণ যুদ্ধ আবার শুরু হলে, ফিলিস্তিনি ও বন্দিদের পাশাপাশি গোটা ইসরায়েলের জন্য এটি আরও বিপর্যয়কর হয়ে উঠবে।