আজ ১০:৩৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
[gtranslate]

গাজাকে দ্বিখণ্ডিত করতে ইসরায়েলের নতুন ছক ‘মোরাগ অ্যাক্সিস’

  • রিপোর্টার
  • আপডেট টাইম : ০৯:২৬:২১ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ এপ্রিল ২০২৫
  • ৮১ বার

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকাকে পূর্ব-পশ্চিমে ভাগ করে দুটি ভাগে বিভক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছে ইসরায়েল। এরই অংশ হিসেবে ‘মোরাগ অ্যাক্সিস’ নামে এক নতুন করিডর দখলের ঘোষণা দিয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

বিশ্লেষকদের মতে, এটি গাজার দক্ষিণাঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে ফেলার একটি কৌশলী পদক্ষেপ। বৃহস্পতিবার (৩ এপ্রিল) যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই এক প্রতিবেদনে জানায়, নেতানিয়াহু গত ২ ফেব্রুয়ারি এই ঘোষণা দেন।

তিনি জানান, গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস ও রাফাহর মধ্যবর্তী একটি বিস্তৃত কৃষিজমিকে ‘মোরাগ অ্যাক্সিস’ নামে অভিহিত করে সেখানে ইসরায়েলি দখলদারির পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রসঙ্গত, ‘মোরাগ’ নামটি নতুন নয়। ১৯৭২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলে অবৈধভাবে গড়ে তোলা একটি ইহুদি বসতির নাম ছিল মোরাগ। ২০০৫ সালে গাজা থেকে বসতি সরিয়ে নেওয়ার সময় সেটি পরিত্যক্ত হয়। বর্তমানে সেই পুরোনো ভূখণ্ডেই এই তথাকথিত করিডর গঠনের ছক আঁকা হচ্ছে।

এই অঞ্চল আগে কখনো করিডর হিসেবে চিহ্নিত ছিল না। বরং, ইসরায়েলি সেনারা এটিকে ‘মানবিক অঞ্চল’ বলে ঘোষণা দিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় নিতে বলেছিল। কিন্তু এখন ওই অঞ্চলেই ইসরায়েল নিজেদের সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই করিডর তৈরির মাধ্যমে খান ইউনিস ও রাফাহ শহরের মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। এতে গাজার দক্ষিণাঞ্চল কার্যত দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়বে। ইসরায়েলের লক্ষ্য হলো, উত্তরের মতো দক্ষিণেও যোগাযোগব্যবস্থা ছিন্ন করে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ দুর্বল করা।

ইসরায়েলের চ্যানেল ১২ এক প্রতিবেদনে বলেছে, এই পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া তথাকথিত ‘শান্তি প্রস্তাব’-এর অংশ। ওই প্রস্তাবে গাজা উপত্যকার কিছু অংশ ইসরায়েলি নিরাপত্তা জোন হিসেবে নির্ধারণ করার সুপারিশ ছিল।

এর আগে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে গত ১৮ মার্চ থেকে ইসরায়েল ফের তীব্র আক্রমণ শুরু করে গাজায়। বিশেষ করে রাফা শহরের ওপর চলমান অভিযানে হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

ইসরায়েলি সেনারা রাফার আবাসিক এলাকায় অভিযান চালিয়ে বেসামরিক মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি চিকিৎসাকর্মীদের লক্ষ্য করে গুলিও চালানো হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছে।

ইসরায়েলি দৈনিক সংবাদমাধ্যম হারেতজ জানায়, প্রতিরক্ষা বাহিনীর কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা এই ঘোষণা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, রাফা ও খান ইউনিসকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনাটি এখনো অনুমোদিত হয়নি। ফলে নেতানিয়াহুর ঘোষণা সেনাদের জন্য মুশকিল ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।

নেতানিয়াহু অবশ্য বলেছেন, আমাদের উদ্দেশ্য হলো রাফা ও খান ইউনিসকে বিচ্ছিন্ন করে গাজার ওপর চাপ সৃষ্টি করা। যতদিন না আমাদের জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত হচ্ছে, ততদিন এই চাপ জারি থাকবে।

এর আগে গাজার উত্তরের নেতজারিম করিডর দখল করে সেখানেও একইভাবে পূর্ব-পশ্চিমে ফিলিস্তিনিদের চলাচলে বাধা তৈরি করেছিল ইসরায়েল। এই একই কৌশল এবার দক্ষিণ গাজার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত মোরাগ অ্যাক্সিস পরিকল্পনা নিয়ে জাতিসংঘ বা পশ্চিমা শক্তিগুলোর পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, গাজার প্রতিটি নতুন সামরিক করিডর মানে মানবিক বিপর্যয়ের আরেকটি অধ্যায়।

ট্যাগ :

Write Your Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

জনপ্রিয়

গাজাকে দ্বিখণ্ডিত করতে ইসরায়েলের নতুন ছক ‘মোরাগ অ্যাক্সিস’

আপডেট টাইম : ০৯:২৬:২১ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ এপ্রিল ২০২৫

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকাকে পূর্ব-পশ্চিমে ভাগ করে দুটি ভাগে বিভক্ত করার পরিকল্পনা নিয়েছে ইসরায়েল। এরই অংশ হিসেবে ‘মোরাগ অ্যাক্সিস’ নামে এক নতুন করিডর দখলের ঘোষণা দিয়েছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু।

বিশ্লেষকদের মতে, এটি গাজার দক্ষিণাঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক কাঠামো ভেঙে ফেলার একটি কৌশলী পদক্ষেপ। বৃহস্পতিবার (৩ এপ্রিল) যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই এক প্রতিবেদনে জানায়, নেতানিয়াহু গত ২ ফেব্রুয়ারি এই ঘোষণা দেন।

তিনি জানান, গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় খান ইউনিস ও রাফাহর মধ্যবর্তী একটি বিস্তৃত কৃষিজমিকে ‘মোরাগ অ্যাক্সিস’ নামে অভিহিত করে সেখানে ইসরায়েলি দখলদারির পরিকল্পনা রয়েছে।

প্রসঙ্গত, ‘মোরাগ’ নামটি নতুন নয়। ১৯৭২ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চলে অবৈধভাবে গড়ে তোলা একটি ইহুদি বসতির নাম ছিল মোরাগ। ২০০৫ সালে গাজা থেকে বসতি সরিয়ে নেওয়ার সময় সেটি পরিত্যক্ত হয়। বর্তমানে সেই পুরোনো ভূখণ্ডেই এই তথাকথিত করিডর গঠনের ছক আঁকা হচ্ছে।

এই অঞ্চল আগে কখনো করিডর হিসেবে চিহ্নিত ছিল না। বরং, ইসরায়েলি সেনারা এটিকে ‘মানবিক অঞ্চল’ বলে ঘোষণা দিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের আশ্রয় নিতে বলেছিল। কিন্তু এখন ওই অঞ্চলেই ইসরায়েল নিজেদের সামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে।

বিশ্লেষকদের মতে, এই করিডর তৈরির মাধ্যমে খান ইউনিস ও রাফাহ শহরের মধ্যে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে। এতে গাজার দক্ষিণাঞ্চল কার্যত দ্বিখণ্ডিত হয়ে পড়বে। ইসরায়েলের লক্ষ্য হলো, উত্তরের মতো দক্ষিণেও যোগাযোগব্যবস্থা ছিন্ন করে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ দুর্বল করা।

ইসরায়েলের চ্যানেল ১২ এক প্রতিবেদনে বলেছে, এই পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দেওয়া তথাকথিত ‘শান্তি প্রস্তাব’-এর অংশ। ওই প্রস্তাবে গাজা উপত্যকার কিছু অংশ ইসরায়েলি নিরাপত্তা জোন হিসেবে নির্ধারণ করার সুপারিশ ছিল।

এর আগে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে গত ১৮ মার্চ থেকে ইসরায়েল ফের তীব্র আক্রমণ শুরু করে গাজায়। বিশেষ করে রাফা শহরের ওপর চলমান অভিযানে হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু হওয়া এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৫০ হাজার ৪০০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন।

ইসরায়েলি সেনারা রাফার আবাসিক এলাকায় অভিযান চালিয়ে বেসামরিক মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এমনকি চিকিৎসাকর্মীদের লক্ষ্য করে গুলিও চালানো হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছে।

ইসরায়েলি দৈনিক সংবাদমাধ্যম হারেতজ জানায়, প্রতিরক্ষা বাহিনীর কিছু শীর্ষ কর্মকর্তা এই ঘোষণা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, রাফা ও খান ইউনিসকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনাটি এখনো অনুমোদিত হয়নি। ফলে নেতানিয়াহুর ঘোষণা সেনাদের জন্য মুশকিল ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে।

নেতানিয়াহু অবশ্য বলেছেন, আমাদের উদ্দেশ্য হলো রাফা ও খান ইউনিসকে বিচ্ছিন্ন করে গাজার ওপর চাপ সৃষ্টি করা। যতদিন না আমাদের জিম্মিদের মুক্তি নিশ্চিত হচ্ছে, ততদিন এই চাপ জারি থাকবে।

এর আগে গাজার উত্তরের নেতজারিম করিডর দখল করে সেখানেও একইভাবে পূর্ব-পশ্চিমে ফিলিস্তিনিদের চলাচলে বাধা তৈরি করেছিল ইসরায়েল। এই একই কৌশল এবার দক্ষিণ গাজার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করা হচ্ছে।

এখন পর্যন্ত মোরাগ অ্যাক্সিস পরিকল্পনা নিয়ে জাতিসংঘ বা পশ্চিমা শক্তিগুলোর পক্ষ থেকে সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি। তবে মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, গাজার প্রতিটি নতুন সামরিক করিডর মানে মানবিক বিপর্যয়ের আরেকটি অধ্যায়।